১১ সেপ, ২০১৩

আমার কৈফিয়ৎ-- কাজী নজরুল ইসলাম

বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’, 
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি! 
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে 
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে! 
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’ 
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী! 

কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে! 
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’। 
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা। 
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা। 
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে! 
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে! 



গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা! 
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’ 
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’ 
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি। 
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’ 
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা! 

মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্‌-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’, 
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে! 
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও, 
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও! 
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে! 
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’ 

আনকোরা যত নন্‌ভায়োলেন্ট নন্‌-কো’র দলও নন্‌ খুশী। 
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্‌’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি! 
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে, 
‘নয় চর্‌কার গান কেন গা’বে?’ 
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্‌ফুসি! 
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি! 

নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী! 
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’ 
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’- 
যুগের না হই, হজুগের কবি 
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্‌-পেশী, 
দু’কানে চশ্‌মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্‌ বেশী! 

কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু? 
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু! 
বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম, 
রাজ-সরকার রেখেছেন মান! 
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু 
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু? 

বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে, 
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে! 
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল, 
মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল, 
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে। 
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’! 

আমি বলি, ওরে কথা শোন্‌ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্‌ খোশ্‌-হালে! 
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্‌, এবার এ দাঁও ফস্‌কালে 
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়! 
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায় 
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে 
নিস্‌ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে। 

বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে, 
গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে! 
রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী, 
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী, 
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে। 
মাতা কয়, ওরে চুপ্‌ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্‌ চেয়ে! 

ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন, 
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন। 
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়, 
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়! 
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন 
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন? 

আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস! 
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস 
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ! 
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ। 
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস! 
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ! 

বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে! 
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে। 
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা, 
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা, 
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে! 
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে! 

পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে, 
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে। 
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, 
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন